চকরিয়া প্রতিনিধি :: গুটিকয়েক বালুদস্যুর অবৈধ আয়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ৩০ টন ওজনের বালুভর্তি ডাম্পার গাড়িসহ অত্যধিক ভারি যানবাহন চলাচলের কারণে শেষপর্যন্ত দেবে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ মাতামুহুরী সেতুর মাঝখানে। এতে ব্যস্ততম এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় গত বুধবার রাত আটটার পর থেকে। অবশ্য রাতেই দেবে যাওয়া অংশে দুই লেনের একপাশে স্টিলের পাটাতন ও গার্ডার দিয়ে অনেকটা বেইলি সেতুর আদলে মেরামত কাজ সম্পন্ন করে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) আওতায় মাতামুহুরী নদীর উপর দ্বিতীয় নতুন সেতু নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার পর থেকে মেরামত করা এক লেন দিয়ে সীমিত আকারে ওয়ানওয়ে হয়ে যানবাহন চলাচল সচল করা হয়।
এদিকে মেরামত কাজের জন্য মাতামুুহরী সেতুর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও বিকল্প হিসেবে মহাসড়কের বরইতলী রাস্তার মাথা থেকে পেকুয়া-বাঘগুজারা-লালব্রিজ-চৌঁয়ারফাঁড়ি টু চকরিয়া-বদরখালী সড়ক এবং পৌরশহরের চিরিঙ্গা থানা রাস্তার মাথা হয়ে কক্সবাজারের সাথে যানবাহন চলাচল করছে। তবে ওই সময় কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম রুটের হাজারো যানবাহনকে বিকল্প সড়ক পার হতে লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে তীব্র ভোগান্তি ও ভয়াবহ যানজটের কবলেও পড়তে হয় যাত্রী-সাধারণ ও পণ্যবাহী যানবাহনগুলোকে।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় মাতামুহুরী সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সেফ্টি সুপারভাইজার মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘অত্যধিক ভারি যানবাহন চলাচলের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ মাতামুহুরী সেতুর মাঝখানে দুই লেনের পুরোটাই এমনভাবে দেবে যায়, সেখানে কোন যানবাহন চলাচলের উপযোগী ছিল না। তাই বুধবার রাত আটটার পর থেকে এই সেতুর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর রাতারাতিই দেবে যাওয়া অংশের এক লেনে স্টিলের পাটাতন ও গার্ডার দিয়ে বেইলি সেতুর আদলে ঢেকে দেওয়া হয়। এতে মেরামতকৃত এক লেন দিয়ে আজ (গতকাল) সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলাচল শুরু করা হয়।’ তিনি আরো জানান, একইভাবে দেবে যাওয়া অংশের অপর লেনেও আজ রাতে (গতরাতে) মেরামত কাজ শুরু করা হবে। ওইসময় থেকে আজ শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে এই সেতু দিয়ে। তবে বিকল্প সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, চারবছর আগে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় মাতামুহুরী সেতুর উপর দিয়ে ১০ টনের অধিক ভারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা মেনেই যানবাহন চলাচল করছিল সেতুটির ওপর দিয়ে। কিন্তু গত দুইমাস ধরে বর্তমান সেতুর নিচ এবং আশপাশ থেকে অবৈধভাবে বালু ও মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছিল প্রভাবশালী বালু দস্যুরা। আর ১০ চাকার ডাম্পারভর্তি করে এসব বালু পরিবহনের সময় ব্যবহার করা হচ্ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতুকে। এতে অনেকটাই মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুটির মাঝখানের কংক্রিটের ঢালাই ব্যাপকভাবে দেবে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সতর্ক করে দিয়ে এই কর্মকর্তা আরো বলেন, দেবে যাওয়া অংশে এখন স্টিলের পাটাতন ও গার্ডার দিয়ে মেরামত তথা বেইলি সেতুর আদলে তৈরি করে দিয়ে যানবাহন চলাচল সচল করা হলেও তা কোনভাবেই টেকসই নয়। তার ওপরও যদি ৩০ টন ওজনের বালুভর্তি ডাম্পারসহ অত্যধিক ভারি যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয় তাহলে সামনে আরো বড় ধরণের বিপদ অপেক্ষা করছে এই সেতুর জন্য। অবশ্য বিদ্যমান মাতামুহুরী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের পুরোটাই দায়িত্ব বর্তমানে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ)। তাই এই দপ্তরই সেতুটির যাবতীয় দেখভাল করবে।
চকরিয়া ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. সেলিম উদ্দিন ও সার্জেন্ট মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ মাতামুহুরী সেতুর উপর দিয়ে ওয়ানওয়ে হয়ে দুইদিকের যানবাহন চলাচল করছে একেবারে সীমিত গতিতে। এতে দীর্ঘ যানজটেরও সৃষ্টি হচ্ছে সেতুর দুইপ্রান্তের একদিকে চকরিয়া পৌরশহর এবং অপরপ্রান্তের জিদ্দাবাজার পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, বিদ্যমান পুরোনো সেতু দিয়ে যান চলাচল সচল এবং স্থায়িত্ব ধরে রাখতে সেতুটির সন্নিকটের নদীর উজান এবং ভাটির এক কিলোমিটার এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটা বন্ধের দাবি জানিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পর পর দুইবার পত্র দেন ছয় লেনের দ্বিতীয় মাতামুহুরী সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক (পূর্ব) সুপ্তা চাকমা। প্রেরিত পত্রে বিষয়টি অতীব জরুরি এবং এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেও অবহিত করা হয়। পত্রটি গত এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ ইস্যু করা হলেও এখনো পর্যন্ত কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। সেতুর একেবারে কাছ থেকে এক্সেভেটর দিয়ে অবৈধভাবে বালু ও মাটি কেটে ১০ চাকার ৩০ টন ওজনের ডাম্পার ভর্তি করে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
প্রেরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, জাইকার অর্থায়নে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) আওতায় মাতামুহুরী নদীর উপর নতুন সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। বর্তমানে সেতু নির্মাণের স্থানে নদীশাসন ও নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য নিয়োজিত ঠিকাদার কর্তৃক যথাযথ ডিজাইন অনুসরণ করে কনসালটেন্ট ও সওজ’র প্রতিনিধির নির্দেশনা মোতাবেক বালু উত্তোলন বন্ধ ও নদী খননসহ অন্যান্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিন্তু কতিপয় লোকজন কনসালটেন্ট ও সওজ’র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সেতুর সন্নিকটে বালু উত্তোলন করে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। যা সেতুটির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একই পত্রে সেতুর এক কিলোমিটার উজান এবং ভাটির মধ্যে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটা অবকাঠামোগত দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।
পাঠকের মতামত: